কার্তিকের কুয়াশা

 

হাইব্রিড মানব
নুরুল আজম


পথে দেখা আমার পুরোনো বন্ধুর সাথে। আমি ভাবতেই পারিনি তার সাথে আবার দেখা হবে। আমি যখন ভাবতাম, পৃথিবীটা আমাদের পরের গ্রামের পর শেষ, আকাশের তারাগুলো আসলে মোমবাতির আলো, বাড়ির পাশের তাল গাছটা তে উঠলেই তাদের ধরা যাবে, তারও আগে নিসঙ্কের সাথে আমার পরিচয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা নিসঙ্কেকে নিয়ে কাটতো আমার। সে আমার শৈশবের সমার্থক। তাদের বাড়িটা ছিল ঠিক আমাদের পাশে। তখনো তেমন লোকালয় গড়ে উঠেনি আমাদের আশে পাশে। যতদূর চোখ যেত শুধু বিল আর বিল। পাশে ছিল প্রবাহমান নদী। কত মজার স্মৃতি নদীর তীরে। ধীরে ধীরে আমাদের আত্নীয় হয়ে উঠল তারা। আমার অদ্ভূত লাগত তাদের। তবুও খুশী ছিলাম নিসঙ্কের মত খেলার সাথী পেয়ে। আমি এটা ওটা করতাম আর সে তাকিয়ে থাকত, যাই বলতাম তা চিরধার্য হিসাবে পালন করত।

যখন একটু বড় হলাম, আমরা পৃথিবী মহাকাশ নিয়ে কথা বলতাম। আসলে সেই বলত। আমি অবাক হয়ে শুনতাম। সে বলত, পৃথিবীটা সূর্যের চারিদিকে ঘুরে। ঐ যে অকাশের তারাগুলো, আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে, কতইবা বয়স তখন, সাত কি আট! নিসঙ্কের মনের পৃথিবী দৃশ্যমান পৃথিবী থেকে অনেক বড় ছিল। ওর অন্তরমুখী স্বভাব দেখে খুব রাগ হত আমার। প্রায় সময়ই মনে হত সে সব কিছু জানে। আমি আসলে বুঝতেই পারিনি নিসঙ্ক আসলে কি ছিল। সে অনেক কাহিনী।



একদিন নিসঙ্কদের বাসায় তাকে খুজঁতে গেলাম। সে কি যেন একটা লিখছিল। তার কাছে গিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। কাগজে কোন লেখা নাই, অথচ সে কি যেন লিখছে! সে খুব দ্রুত অদৃশ্য লেখা লিখেই যাচ্ছে। আমি সাহস করে বললাম "এই নিসঙ্ক কি করিস?" ওর গায়ে হাত দিতেই, আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। শীতল ঠান্ডা ওর শরীর। ও আমার দিকে নীলাভ চোখে তাকিয়ে জবাব দেয় "আমি তোর মত মানুষ নারে"।
চির জীবনের জন্য ওই উত্তরটা দাগ কেটে যায় আমার মনে। এর মানে যে কি আমার কৈশর মন ঠিক বুঝতে পারেনি। ওর নীলাভ চোখের দৃষ্টির মধ্যে অপরিচিত অজানা এক অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি দৌড়ে বাসায় চলে আসি।
পরের দিন নিসঙ্ক আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, সহজ সরল নিসঙ্ককে কেমন ভয় করতে থাকে আমার। আম্মা বললেন কিরে, তোর বন্ধু তো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভিতরে আসতে বল। আমি বললাম "না, মানে ঠিক আছে আমরা বাইরে যাব।"
আম্মা বললেন, বেশী দেরী করবি না কিন্তু।
আমরা বের হয়ে এলাম। নিসঙ্ককে বললাম "নদীর পাড়ে যাবি?" যথারীতি ওর হ্যাঁ উত্তর। আমি এতদিন নিসঙ্কের যে জিনিসটি লক্ষ্য করিনি, তার অনুভূতি শুন্যতা। সে রাগে না কিংবা হাসে না।

আমরা নদীর পাড়ে বট গাছটার নীচে বসলাম। নিসঙ্কের চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। সে বলল "ভয় পেয়েছিলি কাল?"
"না, মানে ভয় পায় নাই। কি হয়েছিলরে তোর?"
"না কিছু হয় নাই, আমাদের একজন যোগাযোগ করতে চাচ্ছিল।"
"আমাদের একজন?"
"হুম,আমাদের একজন।"
"তোর সাথে যোগাযোগের মানে কি?, তুই তো কি যেন একটা লিখতেছিলি।"
"না ব্যাপরটা সেরকম না। আমি তোকে এখন এমন কিছু কথা বলব যার জন্য হয়তবা তুই প্রস্তুত না। তবুও বলব, কোন একসময় হয়ত বুঝবি।" খুব গম্ভীর ভাষায় বলল নিসঙ্ক।
"মানে কি? কি বলতে চাচ্ছিস তুই?" আমার চোখে মুখে কৌতুহল।
"আমি জি.এম মানব। জেনেটিক্যালি মডিফাইড মানুষ। লক্ষ্ বছরে বির্বতিত জিনে জোর করে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে আমার শরীরে। আমাকে দেয়া হয়ছে সত্যিকারের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়। ব্রেইনের ওয়েব প্যাটার্নের পরিবর্তনে অনেক কিছু বলে দিতে পারি আমি কিংবা তিমি মাছদের মত যোগাযোগ করতে পারি অনেক দূর পর্যন্ত। সত্যিকার অর্থে আসলে আমি স্বাভাবিক মানুষ না। শুধু আমি না আমার মত অনেকেই। আমি চাইলেই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। তোকে এত কিছু যে বললাম সেটা তারাই জানিয়েছে। আমিও অবশ্য পরীক্ষা করে দেখছি ব্যাপারটা।" এক নিঃশ্বাসে বলে গেল নিসঙ্ক।
"তাহলে তোদের পরিবার?"
"সবই সাজানো। তারা আসলে আমার সত্যিকার বাবা মা নন"
"আমিতো কিছু বুঝতেছি না নিসঙ্ক"
"আমাকে কিছু প্রশ্নের জবাব পেতে হবে নিহাত"
নিসঙ্কের কথা বলার ধরন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।



নদীর পাড়ে সেই ছিল নিসঙ্কের সাথে শেষ দেখা। হঠাৎ কোথায় যেন সে হারিয়ে গেল। নিসঙ্কের বাবা রাতে আমাদের বাসায় তাকে খুজঁতে আসে। মা রীতিমত আমাকে জেরা শুরু করে দেয়। আমি কিছুই জানাইনি। শুধু নিসঙ্কের বাবার প্রতিক্রিয়াটা দেখছিলাম, সেখানে নিসঙ্কের প্রতি তার ভালোবাসার খাদ ছিল না। তখনি বুঝেছিলাম নিসঙ্ক আর ফিরবেনা। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর। নিসঙ্ক ফিরেনি। সে আমাকে যে তথ্যটা দিয়ে গেল, তা বয়ে বেড়ালাম বহু বছর। আমিও অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। লাভ হয়নি তাতে। এরপর কেটে গেল অনেকদিন।

নিসঙ্কের কারনে কিনা জানিনা, আমি পড়াশুনা করি জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং এ। সারা জীবন ওর কথাগুলোর অর্থ খুঁজে বেড়িয়েছি। জেনেটিক ইন্জিয়ারিং -এ নেওয়া হয়েছে পিএইচডি। লিখেছি প্রচুর পেপার। গবেষণা তো চলছেই। দেশে বিদেশে প্রচুর নাম আমার। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন কন্ফারেন্সে দৌড়াতে হয়। এরই মধ্যে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট কন্ফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য গেলাম ইউ.এস.এ তে। বিশাল ব্যস্ততার মধ্যে যাচ্ছিল সময়গুলো। বিকেলের দিকে কিছু সময় পাওয়া গেল। হাঁটতে বের হলাম বাইরে। আমি জানতাম না আমার জন্য কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে,পথে দেখা আমার পুরোনো বন্ধুর সাথে। আমি ভাবতেই পরিনি যে নিসঙ্কের সাথে দেখা আর হবে।

-নিসঙ্ক? তুই এখানে?
-এস্কুউজ মি। হ্যাভ উ স্যাইড সামথিং?
-নিসঙ্ক তুই আমাকে চিতে পারিস নাই? আমি নিহাত, তোর বন্ধু।
-স্যরি, হুইস ল্যানঙ্গুয়েজ ইজ দিস?
আমি নিসঙ্কের দিকে চেয়ে রইলাম,
-ইউ লুক লাইকস ফ্রেন্ড অব মাইন, ফ্রম এ কান্ট্রি নেইমড বাংলাদেশ।
-ব্যাংলাডেশ? হয়্যার ইট ইজ?
-ক্যান উই হ্যাভ এ চ্যাট?
-সিউর। বাট আম রং পারসন, দ্যাট ইউ লুকিং ফর।
(ইংরেজী কথোপোকথনের বাংলা অনুবাদ)
-আপনার হাতে যথেষ্ট সময় আছে? মি....
-আমি থমাস ন্যাস। হুম আছে, তবে আপনার বন্ধুর ব্যাপারে আমি দুঃখিত।
নিহাত, থমাস ন্যাসের সাথে পাশের রেস্টুরেন্টে ঢুকল।
-না। ঠিক আছে। আমাকে সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, মি.ন্যাস। আমি ড. নিহাত। ইউনিভার্সিটির কন্ফারেন্সে যোগ দিতে আসা একজন স্কলার।
-বিয়ার হবে? ন্যাসের দিকে তাকিয়ে বলল নিহাত ।
-না। কফি হলে চলবে। আপনার নামটা পরিচিত মনে হল। আপনার জন্য কি সাহায্য করতে পারি? বলল ন্যাস।
নিহাতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
-আমার নাম পরিচিত মনে হচ্ছে?
-না, মনে হল হঠাৎ
.........

নিহাত ন্যাসের সাথে কথা বলে বুঝল গড়পড়তা আমেরিকান সে। কিন্তু এশিয়ান চেহেরার স্পষ্ট ছাপ,অনেকটা নিসঙ্কের সাথে মিলে যায়। নিহাতের মনে হতে থাকে কোথায় যেন সমস্যা আছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুনোর সময় ন্যাসের ব্যবহার করা গ্লাসটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল নিহাত। সাথে ন্যাসের ব্যবহার করা টিস্যু ও। পাশে বসা এক লোকের চোখে পড়ল সেটা। নিহাত দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।

কফারেন্সরুমে ফিরে আসল নিহাত, কিছুক্ষণের মধ্যে ওরাল সেশন শুরু হবে। নিহাত কিছুতেই মন দিতে পারছে না কাজে। দায়সারা ভাবে সেশন শেষ করে হোটেল রুমে ফিরে এল। রুমে এসে ভাবতে থাকে সে। নিসঙ্কের মুখই শুধু মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। ন্যাস কি নিসঙ্কের ক্লোন হতে পারে? নিহাত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকার ন্যাস আর বাংলাদেশের নিসঙ্ক, ক্লোন হবে কেন? নিহাতের মনে পড়ে যায়, নিসঙ্কের কথা গুলো "সত্যিকার অর্থে আসলে আমি স্বাভাবিক মানুষ না। শুধু আমি না আমার মত অনেকেই। আমি চাইলেই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।"



অনেক কষ্টে ইউনিভার্সিটির ডিএনএ ল্যাব ব্যবহার করার সুযোগ পেল নিহাত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু ড.রিফাত ইউনিভার্সিটির ডিএনএ গবেষণাগারে কাজ করে। ফলে ব্যপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ন্যাসের ব্যবহার করা গ্লাস আর টিস্যু থেকে ডিএনএ স্যাম্পল বের করে আনে সে। এর পরের কাজ সিকুয়েন্সিং করা। রিফাতও বেশ সাহয্য করে এই কাজে। একসময় শেষ হয় ডিএনএ সিকুয়েন্সিং। নিহাত ডেটা গুলো নিয়ে নেয়।


atgtctgattcgctaaatcatccatcgagttctacgg......


-এটা ইউনিভার্সিটির ডাটাবেইসে রাখবে না? বলল রিফাত।
-না, এটা আমার ব্যক্তিগত গবেষণা।
-কিন্তু ইউনিভার্সিটির রুল অনুসারে তো যে সব ডিএনএ সিকুয়েন্সিং করা হয়, সেটা ডাটা বেইসে রাখার নিয়ম। বলল রিফাত।

অনেক কষ্টে রিফাতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ল্যাব থেকে হোটেলে রুমে চলে আসে নিহাত। হিউম্যান জিনোমের ডাটা বেইসটা একসেস করতে হবে। গবেষণার জন্য যত ধরনের জিন সিকুয়েন্সিং করা হয় সেটা এই ডাটা বেইসে রাখা হয় এবং বড় গবেষক না হলে এই ধরনের ডাটাবেস একসেস করা যায় না। ন্যাসের ডিএনএ সিকুয়েন্সটা ডাটা বেইসে ঢুকিয়ে সার্চ দিল নিহাত। ৭১ টা ম্যাচ। নিহাত অবাক হয়ে যায় সংখ্যাটা দেখে। এই ক্ষেত্রে বড়জোড় চার থেকে পাঁচটা ম্যাচ হতে পারে শুধুমাত্র নিকট আত্নীয়ের ডিএনএ হলে।
প্রথমটাতে টমাস ন্যাস। নিহাত চোখ বুলাতে থাকে।
৫৩ নম্বর ম্যাচের রেজাল্ট দেখে বিস্মিত হয়ে যায় নিহাত। নিশঙ্কের নাম সেখানে। নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না নিহাত। নিশঙ্কের নাম লিখে আগেও এই ডেটাবেইস দেখেছে। কিন্তু কোন ম্যাচ দেখায় নি তখন। নিহাতের বুঝতে বাকি থাকে না, থামাস ন্যাসের কাজ এটা। সে সম্ভত ইউ.এস.এ গোপন কোন সার্ভার হ্যাক করে এই ডাটা গুলো যোগ করেছে। সেই মুহূর্তে দরজায় নক। দরজা খুলল নিহাত। যা সন্দেহ করেছিল তাই।
-আপনি ড. নিহাত?
-হ্যাঁ।
-আমরা ইউ.এস সাইবারনেটিক্স ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট থেকে। আপনাকে যেতে হবে আমাদের সাথে।
-আমার অপরাধ?
-আপনি ইউ.এস গোপন সার্ভার হ্যাক করেছেন।
-কিন্তু....নিহাত কিছু একটা বলতে গিয়ে বলল না।



নিহাত নিজেকে আবিষ্কার করে ছোট একটি রুমে। টেবিলের উপর উজ্জ্বল আলো। সাদা রঙের দেয়াল। সামনে একটা গ্লাস। খুব সম্ভত ওয়ান ওয়ে মিরর সেটি। অন্যপাশ থেকে হয়ত কেউ তাকে লক্ষ্য করছে।
খয়েরী স্যূট পড়া একজন রুমে ঢুকল।
-স্বাগতম ড. নিহাত । আপনাকে আমরা জেনেটিক্স ইন্জিনিয়ার হিসাবে চিনতাম, হ্যাকার হলেন কবে থেকে?
-হ্যাকিং? আমি শুধু মাত্র হিম্যান জিনোম ডেটা বেইসটা একসেস করেছি এবং গবেষক হিসাবে সেটা একসসে করার অধিকারও আমার আছে।
-আপনি হযতোবা জানেন না। আপনি যে ইন্টারনেট সংযোগটি ব্যাবহার করেছেন সেটা নিরাপদ কোন সংযোগ ছিল না। আপনার প্রত্যেকটা কাজের রেকর্ড আমাদের কাছে আছে, এমনকি ইউনিভার্সিটির ল্যাবে করা জিনস সিকুয়েন্সটিও। আপনি কেন করছেন এসব? এতে কি লাভ?
-আমি জানতে চাই। নিশঙ্কের ব্যাপারে। এই সব কাজ নিশ্চয় আপনাদের। অনৈতিক ভাবে আপনারা জিন মিউটেশন ঘটিয়েছেন। তৈরী করেছেন মানব ক্লোন। আমার কাছে তার স্পষ্ট প্রমান আছে।
লোকটি হেসে উঠল।
-গুড,আপনি তো ভালো ডিডেকটিভ ও ।
লোকটি গ্লাসের দিকে ইশারা করল আর রুমের আবহটাও পরিবর্তন হয়ে গেল। মিরর গ্লাসটাও দেখা যাচ্ছেনা। এখন যে কথাগুলো হবে সেটি শুধু আপনি আর আমার মধ্যে।
নিউটনের কথাটি নিশ্চয় শুনেছেন আপনি। If I have seen further it is by standing on the shoulders of giants। কথাটির কিন্তু বিশাল গুরুত্ব আছে। নিউটন হয়তো কোন গোপন তথ্য দিয়ে গেছেন এর মধ্যে। আমরা গবেষণা করলাম এই নিয়ে। লক্ষ্য করলে দেখবেন ১৫০০ এরপর পৃথিবীর মানুষের মস্তিষ্ক অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভালো কাজ করেছে। হঠাৎ এই গতি পেল কিভাবে মানুষ? নিউটনের ঐ কথায় সেটার সামান্য হলেও উত্তর আছে।
নিহাত মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে।
-সেই যাই হোক, আমরা অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্রজেক্ট জায়ান্ট হাতে নিলাম আমরা। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন, আপনি প্রজেক্ট জয়ান্টের একটি প্রোডাক্ট।
-আমি? অবিশ্বাসের সুরে বলল নিহাত।
-জায়ান্টের জায়গায় নিশঙ্ককে বসিয়ে দিন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
-মানে?
-আপনি এত অল্প বয়সে এতগুলো রিসার্চ করলেন কিভাবে? সেটা খেয়াল করে দেখেছেন? অন্যান্য ফিল্ডে এত দ্রুত অগ্রগতি হল কিভাবে? এনটার্ডো নামে স্পেসশীপের কথা তো শুনেছেন, 0.৫c গতিতে চলে। সেটা তৈরীতে আপনাদের মত মস্তিষ্কের বিশাল ভূমিকা ছিল। এক কথায় প্রজেক্ট জায়ান্ট সফল একটি প্রজেক্ট। তবে ভয় পাবেন না। আপনি কোন ক্লোন না, স্বাভাবিক মানুষই। তবে শৈশবে আপনার ব্রেইনে স্টিমুলেশন দেয়া হয়েছে মাত্র, সেই কাজটা করেছে নিসঙ্ক। If you see further than others, it is by standing on the shoulder of Nishonko.
এইবার সম্ভত বুঝতে পেরেছেন। নিসঙ্কের মত হাইব্রিড সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু ব্রেইনের কাজ করার সামর্থ্যটা বাড়িয়ে তোলার জন্য। এরা নিখুঁতভাবে এই কাজটা করতে পারে। আপনারা এখন ব্রেইনের ৩০% পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আইনষ্টাইন কত পারত জানেন? ১২% মাত্র।
-কোথায় এখন নিসঙ্ক ? বলল নিহাত।
-সেটা আপনি শুনে কি করবেন ? কিছুক্ষনের মধ্যেই নিসঙ্ক সংক্রান্ত সকল স্মৃতিই মুছে দেয়া হবে আপনার মস্তিষ্ক থেকে। আপনার অতি কৌতুহলের ফল বলতে পারেন এটাকে।
নিহাত শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে।
-তবে, আপনাকে এইটুকু বলতে পারি, সে বেঁচে আছে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নিসঙ্কের ক্লোন গ্রুপ। থমাস ন্যাসের কথা মনে আছে নিশ্চয়, সে কি আপনাকে কোন তথ্য দিয়েছিল? সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল আপনি কে।
-নিহাত শুধু একটি কথাই বলল, আমাকে অত বোকা ভাববেন না।



কনফারেন্সের পরের দিন নিহাতকে পাওয়া যায় একটা বারে অচেতন অবস্থায়। দেশে ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। তেমন কাউকে চিনতে পারছে না নিহাত। শৈশবকে সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। স্মৃতিগুলো যেন খন্ড খন্ড ভাবে ছড়িয়ে আছে তার মাথায়। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। নিহাতের মা তাকে গ্রামে নিয়ে আসে। সারা জীবন সে পড়াশুনা করে কাটিয়েছে। গ্রামে আসা হয়নি অনেকদিন। নদীর পাড়ে বট গাছটার নীচে বসে নিহাত সময় কাটায়। কোথায় যেন ছেদ পড়েছে। নিহাত শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে আর নিজেকে খুজেঁ ফিরে।
-নিহাত?
অপরিচিত কেউ একজন ডাক দেয়। নিহাত পেছন ফিরে, না একে দেখেনি সে আগে কখনো।
-চেনা যায় আমাকে? বলল লোকটি।
-আপনাকে আমি কিভাবে চিনব? বলল নিহাত।
-আমি নিসঙ্ক নিহাত! তোর হারিয়ে যাওয়া বন্ধু।
-নিসঙ্ক?
মা অনেক বার বলেছেন নিসঙ্কের কথা। কিন্তু সে কিছুই মনে করতে পারে নি। এটা সম্ভবত ডাঃ চাচার কোন ট্টিক্স।
-নিহাত তাকাও আমার দিকে, লোকটি কতৃর্ত্বের সুরে বলল। নিহাত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির চোখের দিকে। নীলাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে তার চোখ থেকে। নিহাত আর কিছু দেখতে পায় না, শুধু নীল,সবুজ রঙের খেলা। দৃষ্টির গভীর থেকে গভীরে ঢুকে যায় সেই রঙ।
কিছুক্ষণ পর নিহাত পরে যায় মাটিতে। লোকটি ধরে ফেলে তাকে।
-নিহাত? নিহাত.....
বুকে কান পেতে দেখে নিসঙ্ক। বেঁচে আছে সে।
নদীর পানি মুখের উপর দিতেই জ্ঞান ফিরে পায় নিহাত।
-চেনা যায় আমাকে নিহাত?
-থমাস ন্যাস। তুমি এখানে? বলল নিহাত।
-আমি নিসঙ্ক।
-সত্যিই তুই নিসঙ্ক? কই ছিলি এত দিন? নিসঙ্ককে জড়িয়ে ধরে কাদঁতে থাকে নিহাত।
-ঐযে প্রশ্ন গুলো জবাব খুঁজেছি।
-এখন নিশ্চয় সব জানিস?
-হুম। তোর জন্য সম্ভব হয়েছে সব। আমরা অভিন্ন সত্ত্বার অনেকগুলো মানুষ। আসলে হাইব্রিড মানুষ সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নাই। তবে মূল ব্যপারটা হল পৃথিবীতে মানুষ প্রজাতি ভাগ হয়ে গেল। সাধারন আর হাইব্রিড...

একজন জেনেটিক্স ইন্জিনিয়ার হিসাবে নিহাতের অনুভূতিটা ছিল মিশ্র।
©